Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

ছবি
শিরোনাম
পড়ন্ত বিকালে মর্জাত বাওড়
বিস্তারিত

সূর্য়্য অস্তের সময়ে বাওড়ে অপরুপ দৃশ্যের সৃষ্টি হয় যা মনকে বিমোহীত না করে পারে না । শান্ত শিষ্ট বাওড়ের দৃশ্য যা না অবলোকন করলে মর্ম উপলব্ধি করা যায়না ।

বিকেল বেলা। নীল আকাশ উজ্জ্বল সূর্যের দীপ্ত আলোয় ভরে আছে। ঝলমলে সোনালি আভা আছড়ে পড়েছে বাওড়ের পানিতে, গাছের ডালে আর বিস্তৃত সবুজ প্রান্তরে। কী অপূর্ব রূপ ধারণ করেছে চারপাশের প্রকৃতি। নির্ঝরের স্বচ্ছ পানির স্রোতে বইছে মাঝির নৌকা । মৃদু মধুর শব্দে কেমন একটা কুলুকুলু ছন্দে তৈরি হয়েছে গম্ভীর অথচ করুণ সুরের এক মায়াময় আবহ। বাঁশের সাঁকো বেয়ে ছোট্ট ছড়াটি পেরিয়ে এলেই বাঁশবন আর ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে সরু পথটি সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে। অনেকগুলো ছোট ছোট গাছপালা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে বাওড়ের  দু’পাশে।বাওড়ের  উপরিভাগটায় বিচিত্র বৃক্ষরাজির সমারোহ; সবুজে সবুজে ছেয়ে আছে গাছগাছড়া আর লতাগুল্মে।

বাওড়ের পার্শ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পুকুর আর পুকুরের সংকীর্ণ উঁচু পাড় বেয়ে নেমে পশ্চিমে নেমে এলেই চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ ফসলের খেত। উর্বর  জমিতে কৃষকেরা নানান শীতকালীন সবজির আবাদ করেছে। সরু আইল বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে খেত পেরিয়ে একটি ছোটখাট গ্রামীণ সড়কে উঠে আসি। বাওড়ের দক্ষিনে বিস্তৃত মাঠে সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত চারণভূমিতে ঝাঁকে ঝাঁকে গরু-ছাগল চরছে। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে উঁচুনিচু টিলা সদৃস । কোমল দূর্বাঘাসের সবুজ চাদর টিলাগুলোকে ঢেকে দিয়েছে পরম মমতায়। সবুজ প্রান্তরের বুকজুড়ে যত্রতত্র শুভ্র ঘাসফুলেরা দলবেঁধে মাথা তুলেছে। বিকেলের মৃদুমন্দ হাওয়ায় তিরতির কাঁপুনি ধরেছে তাদের শরীরে। একপাশ বঁইচি, কাঁটাচোরা আর শেয়ালকাঁটার ঝোপে ছেয়ে আছে। উঁচু একটি টিলায় চড়ে চারপাশে তাকাই।

ঐ যে বিশাল আসমান! চারদিকে গোল হয়ে নেমে এসেছ। সাদা মেঘবালিকাদের ইতস্তত পদচারণা প্রতি মুহূর্তে এঁকে চলেছে চমৎকার সব আলপনা। উপরে তাকালে মনে হবে, গাঢ় নীল শামিয়ানার নিচে হংসশুভ্র মেঘের ঝালর ঝুলছে। এই নয়নাভিরাম প্রশান্তিময় দৃশ্য দেখেই হয়তো রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়:

পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;

পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;

পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু’জনার মনে;

আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে।

আহ কী অপূর্ব, কী মনোরম, কী প্রাণাভিরাম দৃশ্য! হৃদয়ের গভীরে এক অপার্থিব গুঞ্জন ওঠে—এ উপত্যকা এ বৃক্ষরাজি এরূপ সবুজ পেলো কোথা থেকে? আকাশের এ অন্তহীন নীলিমা, মেঘমালার এমন মনকাড়া শুভ্রতা এলো কোথা থেকে? ওই যে ওখানে বাওড়ের পাদদেশে কৃষকেরা খেতে কাজ করছে; কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটির ঢেলা ভাঙছে, খন্তা দিয়ে মাটি আলগা করে সযত্নে কুমড়ো আর শিমের চারা লাগাচ্ছে। বাওড়ের অগভীর জলাশয় থেকে পাম্প মেশিন দিয়ে খেতে পানি সিঞ্চন করা হচ্ছে। দূর থেকে ভেসে আসা ইঞ্জিনের ভসভস শব্দ কেঁপে কেঁপে মিশে যাচ্ছে বাওড়ের আশে পাশের উঁচুনিচু খানাখন্দ আর সবুজ প্রান্তরে।

মাঠজুড়ে শিশুরা দলে দলে খেলছে, নাচছে, লাফাচ্ছে। অবাক বিস্ময়ে তাদের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকি। আহ! কত শুভ্র শিশুদের কচি হৃদয়, কত নির্মল তাদের আনন্দ, কত উচ্ছল তাদের জীবন! আমারও বড় ইচ্ছে হয় এদের মতো ছোট হয়ে থাকতে, সর্বাঙ্গে ধুলো মেখে হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠতে। ভাবতে ভাবতে মনটা উদাস হয়ে যায়। হারিয়ে যায় সুদূর অতীতে। ধীরে ধীরে হৃদয়পটে শৈশবের মধুময় দিনগুলোর দৃশ্য জীবন্ত হয়ে ওঠে। স্মৃতির রূপালি পর্দায় ভেসে ওঠে সেই দ্বীপটির ছবি যেখানে কাটছে আমার শৈশব, আমার কৈশোর, আমার যৌবন, আমার বার্ধক্য । একদিন আমিও এদের মতো ছোট্ট ছিলাম; এমন শুচিশুভ্র কচি একটি হৃদয় আমারও ছিল; এরূপ নির্মল হাসি-আনন্দে আমার বিকেলগুলোও ঝলমল করত। ইস! কত আনন্দ-হিল্লোলে ভরা ছিল মায়াবি সেই দিনগুলো। হায়, পলাতক সময়ের হাত ধরে সেই সোনালি রূপালি জীবন আজ কোথায় হারিয়ে গেল! মনে হয়, বুদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জিন্দেগির হাসি-আনন্দ ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিচ্ছে তার রঙিন চাদর। বাউল সাধক আব্দুল করিমের সেই অমর অজর পঙক্তিগুলো দলবেঁধে মাতম করে আমার অন্তরাত্মা-জুড়ে:

আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম

আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম

‘…’ করি ভাবনা সেই দিন আর পাব না

ছিল বাসনা সুখি হইতাম।

দিন হতে দিন আসে যে কঠিন

করিম দীনহীন কোন পথে যাইতাম।

 

সারা গায়ে ধূলি মেখে মাঠের একপাশে একমনে মার্বেল খেলছে তিন কিশোর। অদূরে দাঁড়িয়ে নীরবে তাদের খেলা দেখছি। সহসা দৃষ্টি আটকে যায় একজনের চেহারায়। বুকের গভীরে কোথাও যেন খচখচ করে ওঠে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় জীবনের সেই হারানো বন্ধুটির মতো চেহারা। ধুলোমলিন কচি মুখাবয়বে যেন মায়া উপচে পড়ছে। মাথায় উষ্কখুষ্ক লম্বা চুল। টানা টানা আঁখি যুগলের ঢলঢলে চাহনি। পরনে কালো প্যান্ট, ঢিলেঢালা হাফ গেঞ্জি হাঁটুতে নেমে এসেছে। তার দিকে তাকিয়ে সহসা মনে হয়, আমার সেই দুরন্ত কৈশোর এই গ্রাম্য বালকের রূপ ধরে নেমে এসেছে। অপলক নেত্রে চেয়ে থাকি তাদের ক্রীড়ারত দৃশ্যটির দিকে।

ধীরে ধীরে পশ্চিমের আকাশের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে রক্তিম সূর্য। সাঁঝের আঁধার এখনি গ্রাস করবে বাওড়ের উপত্যকা। রাখালেরা গরুর পাল নিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা ছুটছে আপন আপন নীড়ে। ক্লান্ত শিশুরাও হাসিমুখে তাদের সাধের খেলা অসমাপ্ত রেখে ফিরে যাচ্ছে কলোনির দিকে। ওরা তিনজন তখনও খেলছে। আমার উপস্থিতি তাদের নিবিষ্টতায় কোনোরূপ প্রভাব ফেলে না। কিছুক্ষণ পর তারাও থেমে যায়।ফেরার পূর্বে সহসা আমার দিকে চোখ তুলে তাকায়। মুখাবয়বে বিস্ময়ের একটি সূক্ষ রেখা জেগে ওঠে পরক্ষণেই মিলিয়ে যায় । তারপর আনমনে বাড়ির পথ ধরে। তাদের চলে যেতে দেখে সহসা হৃদয়টা মোচড় দিয়ে ওঠে। মন চায় এদের সঙ্গে একটু কথা বলি। আমি মৃদু স্বরে ডেকে উঠি, সালাহুদ্দীন! (এতক্ষণ তাদের পারস্পরিক সম্বোধনে নামটা জেনেছি) থমকে দাঁড়ায় তারা তিনজন। চোখের ইশারায় বলি, কাছে এসো। সসঙ্কোচে এগিয়ে আসে।

ধীরে ধীরে সূর্যাস্তের শেষ আভাটুকুও মুছে যায় পত্রপল্লব থেকে। আশ্চর্য এক নীরবতায় নেমে আসে  এলাকা জুড়ে। সেই সরু পথটি বেয়ে আনমনে হাঁটছি। হৃদয়জুড়ে কান্নার দহন, অশ্রুরা সব এসে ভিড় করছে দু’চোখে, নিশ্চল ঠোঁটদু’টো মৃদু কাঁপছে। ভাবনারা উঁকি দিচ্ছে অতীত ও বর্তমানের জানালার পর্দা তুলে। চারপাশের সবকিছু অপরিচিত মনে হয়। হাতের তালুয় শুভ্র জামায় এখনো লেগে আছে আমার সেই জীবন্ত কৈশোরের ধুলোবালি। সাঁঝের আবছা আঁধারে হাতদু’টো প্রজাপতির ডানার মতো চোখের সামনে মেলে ধরি। হৃদয়ের গভীরে কেবল গুঞ্জরিত হয়—

বিদায় হে পল্লী বন্ধু আমার

বিদায় হে আমার মূর্ত কৈশোর।